ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল

(অনুসন্ধানী আবাহন)

(নিচের লেখাটা শতভাগ মানুষের ক্ষেত্রে যে খাটবেই, এমন নয়। কিন্তু ব্যতিক্রম উদাহরণ নয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এমনটা ঘটে)

আমরা নিত্যজীবনে ক্রমাগত শিকার হই ব্ল্যাকমেইল এর। মোটাদাগে যখন কোন ব্ল্যাকমেইল ঘাড়ে এসে পড়ে, তখন অস্থির হয়ে উঠি। মুক্তির উপায় খুঁজি। সব ওলট পালট করে তার থেকে মুক্তি চাই। অথচ subtle ব্ল্যাকমেইল, যেগুলো মূলত ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল, আমরা নিজেরাই হয়তো বুঝেও ইগনোর করে যাই। ব্ল্যাকমেইলারের সাহস এবং ব্ল্যাকমেইল দুইই বাড়তে থাকে। কিন্তু একসময় এই সাটল ব্ল্যাকমেইলের কম্পলিট গ্রিপে চলে আসার আগে পর্যন্ত, দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে পর্যন্ত বুঝেও বোঝা হয় না, যে ব্ল্যাকমেইলড হচ্ছি। 

না বুঝতে চাওয়ার কারণ আছে অবশ্যই। ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইলার প্রায় শতভাগ ক্ষেত্রেই হয়ে থাকে কাছের মানুষেরা। বাবা-মা, সন্তান, স্বামী-স্ত্রী, প্রেমিক-প্রেমিকা, বন্ধু, সহকর্মী বা এমনই কাছে ও আশেপাশে থাকা মানুষগুলো। ছোটববেলায় বাবা মায়ের ব্ল্যাকমেইল চলতে থাকে কন্টিনিউয়াস। এভাবে না পড়াশুনা করলে, এমন না করে দেখালে, অমুক না হতে পারলে, চলাফেরা অমন না হলে, নিজের ভালোলাগা গলা চেপে না মারলে, বাবা-মা এর সম্মান থাকবে না, তাদের মনে মত হবে না, তারা খুশি হবে না, তাদের মনে কষ্ট দেয়া হবে। এই নিরন্তর ব্ল্যাকমেইল এবং প্রয়োজনে মারধোর, সব মিলে নিজের হাজার ইচ্ছা অনিচ্ছাকে মাটিচাপা দিয়ে, বাবা মায়ের ইচ্ছার কাছেই নতি স্বীকার করা হয়। ব্ল্যাকমেইল এতই সাটল, সন্তান নিজে গিল্ট ফিল করে, কিন্তু ব্ল্যাকমেইলড হচ্ছে বোঝে না, ঐ বয়সে বোঝার ক্ষমতাও থাকে না। বাবা-মা বোঝেনও না সন্তানকে বোঝার চেষ্টার বদলে তারা ব্ল্যাকমেইল করে যাচ্ছেন, বুঝতে চানও না। তারা নিজেরাই ধরে নেন, যা করছেন ভালোর জন্যে করছেন, নিজেরা খুশি থাকেন। যদিও কার ভালো, সেটা বিতর্কের বিষয়।

বাবা মায়ের ব্ল্যাকমেইল এক অনন্তকালীন বিষয়, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এর সাথে মানিয়ে চলতে পারা যায়। মনে মনে ভাবা হয়, নিজেরও তো কেউ থাকবে এক সময়, হোক সে বউ বা বর, প্রেমিক বা প্রেমিকা। সে আমার সব ঠিক রাখবে, তার উপরে পুরো ভরসা, সব ঠিক হবে। এভাবেই তার হাতে তুলে দেয়া হয় ব্ল্যাকমেইল এর অস্ত্র। প্রতি নিয়ত কথায় কথায় নানারকমের ব্ল্যাকমেইল চলতে থাকে। পছন্দমত চলা, কথা মেনে চলা, অপছন্দের কাজ বা বন্ধু বাদ দেয়া, মুহূর্তে সব ফেলে হাজির হওয়া, এমন নানা কিছু নিয়ে ব্ল্যাকমেইল চলতে থাকে। এটা যদি কখনো বুঝে যায়, যে আর সবার চাইতে বেশি ইম্পর্ট্যান্স পাচ্ছে, তো ব্ল্যাকমেইলটা আরো মন খুলে করা হয়। আবারও ইগনোর করা হয়, বুঝতেই চাওয়া হয় না সাটলি ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল হচ্ছে। ভাবা হয়, কত ভাবছে, কত না যেন ভালোবাসা। কে চায় হারাতে ভালোবাসা, সবার যে তীব্র চাহিদা। আর বিবাহিতের ক্ষেত্রে একবার যদি সন্তান হয়, সেই সন্তানই হয়ে ওঠে ব্ল্যাকমেইল এর ইন্সট্রুমেন্ট। সন্তানের প্রতি আপত্য স্নেহ ও ভালোবাসাকে নিয়ে ব্ল্যাকমেইল করেই বিভিন্নভাবে দমবন্ধ করা হয়, বাধ্য করা হয় কথা মেনে চলতে। বাধা পেলে যতটা খারাপ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, তা এড়িয়ে যেতেই আসলে আবারও নিজেকে গলা টিপে মেরে সব মেনে নেয়া হয়, যতক্ষণ না নিজের সহ্যের সীমা অতিক্রম করে। অনেকে তো সারাজীবনেও মুক্তি পায় না।

এই দুরকম সম্পর্ক ছাড়া যেই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে তা হলো বন্ধু ও সহকর্মী। আপনি ঘরে ব্ল্যাকমেইল এর শিকার হয়ে ভাববেন, বাইরের লোকেদের কাছে তো আপনার কিছু বাঁধা নেই, এখানে অন্তত নিশ্চিত। এই তো আমিই নিজের পরিবারের চাইতে বন্ধুদের আপন ভেবে এসেছি, আমার মত অনেকে আছেন। বন্ধুরা কি আপনাকে ছেড়ে কথা বলবে? একেবারেই না। তারা আপনার দুরবস্থার সুযোগ নিয়ে আপনাকে আররো সাটলি ব্ল্যাকমেইল করে যাবে। সাইকোলজিকাল কোয়ারশন টেকনিক হয়তো তারা জানে না, কিন্তু সুযোগ নেয়ায় কম যায় না। নিজের পছন্দমাফিক চালানোর চেষ্টা থাকবে, নিজের অপছন্দের লোকেদের থেকে সরিয়ে আনার চেষ্টা থাকবে, ইউটিলাইজ করে নিজে ভালো থাকার চেষ্টা থাকবে , এমনকি নেশার মধ্যে নামিয়ে আনাটাও থাকে। এবং থাকে সবথেকে বিপর্যয়কারী ব্ল্যাকমেইল, প্রেমের ব্ল্যাকমেইল। এক দুর্বল মুহূর্তে বন্ধু ভেবে বলা কথা বা কাজকে কেন্দ্র করে শুধুই নিজের ভালোলাগার জন্যে, বিপরীত লিঙ্গের বন্ধু শুরু করে ব্ল্যাকমেইল। সে নিজে প্রেম ভালোবাসা হয়তো কিছুই চায় না বা হয়তো চায়, কিন্তু যাকে ব্ল্যাকমেইল করা হয় তাকে হাতের মুঠোয় রাখার তীব্র প্রচেষ্টা চালানো হয়। ভুল করেও ভাববেন না এধরণের থ্রেট সরাসরি আসবে। সরাসরি থ্রেট এ তো ব্ল্যাকমেইল বোঝা যায়, ফলে বিগড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। সাটল থ্রেট আসতে পারে, নিজের মত করে ভার্শান এক্সপোজ করার, যেখানে হয়তো একসময় ঝামেলা মেটে, কিন্তু তার আগে অনেক ক্ষতি হয়ে যায়। থ্রেট আসতে পারে সুইসাইডের, আপনি ভাবতেই পারবেন না, আপনার কারণে খারাপ থেকে কেউ সুইসাইড করছে, এই গিল্ট নিয়ে চলতে হবে। আজকালকার দিনে নিজের পরিচয় গোপন রাখতে বাধ্য হয় অনেকে, থ্রেট আসতে পারে পরিচয় ডিক্লাসিফাই হয়ে যাওয়ার। মজাটা হচ্ছে বন্ধুদের থেকে আসা এই ব্ল্যাকমেইলগুলোর কথা আপনি কাউকে জানাতেও পারবেন না সহজে। আপনাকে খুলে বলতে হবে, যা শোনার বা বোঝার মত কাউকে পাবেন না। বা আপনাকে মিথ্যে দিয়ে ঢেকে যেতে হবে এমন কারো কাছে, যাকে কেন্দ্র করেই আপনাকে থ্রেট দেয়া চলছে। বন্ধু বা সহকর্মী সকলের থেকেই আপনি এসমস্ত ট্রিটমেন্ট পাবেন।

এভাবে ঘরে বাইরে প্রতি নিয়ত আপননি ব্ল্যাকমেইল এর সম্মুখীন হতে পারেন। আপনার করনীয় কি? আপনি তো সবার থেকে সরে একা বাঁচতে পারবেন না। আপনাকে অনেকটা রুঢ় হতে হবে, শক্ত হতে হবে, অন্যের ইমোশনকে গুরুত্ব দেয়ার কিছুই নেই। কারণ আপনাকে বুঝতে হবে , আপনার ইমোশন এখানে মূল্যহীন। ঘরের মানুষগুলোকে চেষ্টা করবেন যথা সম্ভব সাটলি হ্যান্ডল করার, কিন্তু না পারলে গিল্ট না ভেবে প্রত্যাঘাত করুন, আপনাকে তো বাঁচতে হবে। আপনাদের অন্তত একজন মানুষ থাকেই, যাকে বিশ্বাস ব ভরসা করেন পুরোপুরি। তার কাছে নিজেকে ছোট হতে দিতেই বা আপত্তি কেন? ভরসা আছে বলেই তো আপনি ভরসা করেন। সে আপনাকে ঠিক বের করে আনবে আপনার ব্ল্যাকমেইলারের কাছ থেকে। আর তা যদি নাও পারে অন্তত আপনি পাশে থাকার কাউকে তো পাবেন। এবং আবারও বলছি, নিজেকে শক্ত করুন, অন্যের ইমোশনের কাছে নিজেকে জলাঞ্জলি দেবেন না।

মন্তব্যসমূহ