কত কথা তারে ছিল বলিতে

(সুদেষ্ণা চক্রবর্তী)

আমার বাবার জীবনে আমি আসার পর থেকে , তাঁর জীবন টাই আমূল বদলে গেল। এক আদ্যন্ত বোহেমিয়ান মানুষ শুধু এই একরত্তি প্রাণের মায়ায় সংসারে পুরোপুরি বন্দী হয়ে গেলেন। কিছুটা খামখেয়াল যে রইল না তা নয়, তবে তাঁর সমস্ত স্বপ্ন , কল্পনা , বাস্তব সবকিছু আবর্তিত হতে লাগল মেয়েকে ঘিরে। কিন্তু মেয়ে তা বুঝল অনেক দেরীতে। বুঝল যখন তখন তাকে ঘিরে থাকা, সমস্ত ভার বইতে থাকা , তার সবটুকু যন্ত্রণা বুক পেতে নিয়ে নেওয়ার মানুষ টি সব কিছু উপলব্ধির বাইরে ।

পিতা পুত্রীর ছিল প্রগাঢ় বন্ধুত্ব । এক ই মননে , রবীন্দ্র সঙ্গীতের মায়ায়, সাহিত্য রসের সিঞ্চনে , ছায়াছবির কাল্পনিক দুনিয়ায় বিচরণে , বর্ষার ঘনঘোর মেঘের ঘনঘটায় বিবাগী দুই মন বাপ মেয়ের বয়সের বেড়াজাল টপকে কখন যেন এক হয়ে যেত। পরে সংসারের জটিল চক্রব্যূহে আটকে পরা মেয়ে বাপের হাত ছাড়িয়ে বড্ড অধরা হয়ে যাচ্ছিল কি ? একেই কি সাবলম্বী হওয়া বলে? পরিণত হওয়া বলে? কে চায় এই বড় হতে ? তোমাকে বলা হল না বাবা, আমি তোমার হাত ছাড়িয়ে চলার মতো বড় হতে আসলে কখনো চাই ই নি।

বাবা প্রতিবার নিজেদের বিবাহবার্ষিকী ভুলে যেতেন। আমিই আগের দিন মনে করিয়ে দিতাম। তখন আমি মাঝে মাঝে শাড়ি পরি। বাবা মায়ের জন্য আনা শাড়িটি মাকে দেওয়ার আগেই , আমার হাতে একটি শাড়ি অবশ্য ই তুলে দিতেন যার মূল্য মায়েরটির থেকে সবসময় বেশী হত। আনন্দের আতিশয্যে উৎফুল্ল আমার কিন্তু নজর এড়াতো না, মায়ের হাসিমুখের উপর বিষাদের একটা ছায়া ক্ষনিক দেখা দিয়েই মিলিয়ে যাচ্ছে। মা বছরে এই একটি দিন ই বাবার কাছ থেকে কিছু উপহার পেতেন , সেখানে আমার ভাগ না বসালে ও তো চলত । আমি স্বার্থপরের মতো কখনো তোমায় বারণ করিনি বাবা । বরং প্রতিবারই অপেক্ষা করে থাকতাম । আসলে আমি বিলক্ষণ জানতাম , তোমার জীবনের কোনো দিন ই তুমি আমাকে বাদ দিয়ে ভাবতে পারতে না। আমার কাছে এ পাওনাগুলো খুব স্বাভাবিক ছিল। এই দুবছর তোমার হয়ে মাকে আমি শাড়ি কিনে দিয়েছি জানো, কিন্তু আমার পাওনাটা বাকি রয়ে গেলো।

আমার জ্যাঠতুতো দাদার প্রতি বাবার একটু পক্ষপাতিত্ব ছিল বলেই আমি মনে করতাম। শুধু দাদা কেন, আমার জ্যাঠতুতো ছোড়দিকে (ফুলদি ) কে ও বাবা মাত্রাতিরিক্ত ভালোবাসতেন। সেই জ্ঞান হওয়া ইস্তক দেখে আসছি, আমার জন্য কিছু কেনা হলে ওদের জন্যেও তা কেনা হবে । এমনকি আমার জন্মদিনে পাওয়া দেশী বিদেশী চকোলেটের বাক্সও আমার খোলার অনুমতি ছিলনা। একমাস পর পৌষমেলার সময় শান্তিনিকেতন গেলে, সেগুলি ফুলদির হাতে তুলে দিতে হত। ফুলদির ভাগ বাটোয়ারাতেই আমায় সন্তুষ্ট থাকতে হত। এ নিয়ে ছোটোবেলায় আমার তেমন আক্ষেপ ছিলনা, কিন্তু বড় হয়ে যখন বুঝলাম, ভালোবাসার গতিধারা শুধু একমুখী তখন খুব রাগ হত। বাবাকে বললে বাবা বলতেন, "যৌথপরিবারে এমন একটু আধটু হয়, ও নিয়ে মাথা ঘামালে চলে না। " কিন্তু একবার আমার সামনে কাকে যেন দাদার সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছিলেন, "আমাদের তো ঐ একটিমাত্র বংশধর ---- "। ব্যস বাবার সাথে পাক্কা তিনদিন কথা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। অনেক সাধ্য সাধনার পর এরকম কথা বাবা আর জীবনে বলবেন না, এই প্রতীজ্ঞায় আবদ্ধ হওয়ার পর মেয়ের মান ভেঙেছিল। বাবা যখন মৃত্যু শয্যায় , তখন আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, দাদাকে দেখতে ইচ্ছে করে কিনা, বলিনি ওদের খবর আমি আগেই পাঠিয়েছিলাম। আশ্চর্য , বাবা তখন খুব নিরাসক্তির গলায়। বলেছিলেন,

" না:। তোকে ছাড়া আর কাউকে দেখতে সাধ হয় না রে। আর তাছাড়া ওরা আসবেও না, ওদের জীবনে কাকুর প্রয়োজন ফুরিয়েছে । "

বাবা নাকি ফুলদিকে ছোটোবেলায় ক্ষেপিয়ে বলতেন,

" মিনি, তুই আমার পেটে জন্মেছিস । দ্যাখ , তোর বাবা , মা দুজনেই কি ফরসা, আর তুই আমার মতো কালো। "

ফুলদি নাকি সেসব বিশ্বাসও করত। তার একটা কারণ বোধহয় আমার জ্যেঠি ওর শিশুকালে বহুদিন অসুস্থ থাকায় এই কাকুর কোলে পিঠেই ও বড় হয়েছে, কাকুর কাছেই ওর যাবতীয় আবদার ছিল। কাকুর ছিল ও নয়নের মণি। কোমর অবদি ঘন কোঁকড়া কোঁকড়া চুল, ভাসাভাসা চোখ, পাতলা ঠোঁট , টিকোলো নাক , ছোট্ট চিবুক , স্লিম ফিগারের ফুলদি আমার চোখে রীতিমতো সুন্দরী ছিল। নিকেতনী সাজপোশাক আর অলঙ্কারে যখন ও সাজতো আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতাম। কিন্তু সে মুগ্ধতা নষ্ট হয়ে যেত যখন, ও আমাকে আমার মামুলি চেহারা নিয়ে খোঁটা দিত।

দাদার বৌভাতের দিন, ফুলদি সাজগোজ করছে। যদিও আমি তখন কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি, কিন্তু বিয়েবাড়িতে সাজবার মতো তেমন প্রসাধনী সামগ্রী আমার ছিল না। মেক আপ বক্সের তো কথাই নেই, লিপস্টিক পরাকেও মা "ঠোঁটে রঙ মাখা " বলতেন। আমি সতৃষ্ণ নয়নে ফুলদির প্রসাধন দেখছি, আর বার বার ঘ্যান ঘ্যান করছি যেন ও আমাকেও অমন মনোমুগ্ধকর রূপে সাজিয়ে দেয়। আমার কিছু তাড়াও ছিল, কারণ মা তখন ও তল্লাটে নেই। মা আসার আগেই রূপান্তরিত হওয়া আবশ্যিক । বার বার তাগাদা দেওয়াতে ফুলদি গলায় ব্যঙ্গ ঝড়িয়ে বলল,

"ঐ তো কেলেভূতের মতো রূপ, এইরূপে আর সেজে কাজ নেই । "

এ ব্যঙ্গোক্তি আমি তো ছোটোবেলা থেকে শুনে অভ্যস্ত , কিন্তু বাবার কান তো আর অভ্যস্ত নয়। বাবা এসেছিলেন আলমারি থেকে নিজের পাঞ্জাবী বার করতে। বাবার কাছে তাঁর এই কেলেকুল্টি নাকবোঁচা মেয়ে পৃথিবীর সেরা সুন্দরী। দুইছেলের মা , বত্তিরিশ বছরের ফুলদি সেদিন বাবার হাতে চড় খেতে খেতে বেঁচেছিল। এরপরে কাকু ভাইঝির সম্পর্ক টা আর তত মধুর থাকেনি। এই নিয়ে বাবার মনে কি কোনো দু:খ ছিল না, নিশ্চয়ই ছিল, কিন্তু আমার কাছে বাবা সেটা কোনোদিন প্রকাশ করেন নি। নিজে থেকে সে ভাঙন টুকু মেরামত করার ও চেষ্টা করেন নি বাবা। আমি তো সেদিন ই বুঝেছিলাম বাবা , তোমার জীবনে আমার জায়গায় আর কেউ নেই। আমার জন্য তুমি দুনিয়ার সমস্ত নিকট সম্পর্ককেও হেলায় অবহেলা করতে পার। তার পরেও কতবার ছোটোবেলার কথা তুলে তোমার উপর কত অনর্থক অভিমান করেছি, তুমি কষ্ট পেয়েও চুপ করে থেকেছ। আমার যে তোমায় বলা হল না বাবা , সে সব মানঅভিমান মিথ্যে, আমি জানি আমিই ছিলাম তোমার সবচেয়ে আপন , তোমার হৃদয়ের স্পন্দন ।

বাবা নিজের সমস্ত উপার্জনটুকু মার কাছে সঁপে দিতেন। মা বাবাকে খুব হিসেব করে টাকা দিতেন , পাছে বাবা বাজে খরচ করেন । তবুও মাকে ফাঁকি দিয়ে উপরি ডিজাইন এঁকে বাবা হয়তো কিছু হাতখরচ মতো নিজের। কাছে রাখতেন, সেই থেকে বাবা দুমাসে এক দিন পার্কস্ট্রিটের কোন এক চীনে রেঁস্তোরা থেকে এক প্যাকেট চিকেন চাউমিন কিনে আনতেন, আমরা তিনজনে তা ভাগ করে খেতাম। আহা কি তার স্বাদ। তখনো আমাদের চন্দন নগরে কোনো চাইনিজ রেস্টুরেন্ট ছিল না, তখনো মফঃস্বলের বাঙালীর ঘরে ঘরে চাউমিন ঘরোয়া হয়ে ওঠে নি। তার কত পরে আমি চাইনিজ রাঁধতে শিখলাম। এখন বরের সাথে কত নামী দামী চীনে রেঁস্তোরায় খেতে যাই । কিন্তু সেই স্বাদ কেন পাই না বাবা ? এ কথা কতবার ভেবেছি তোমায় বলব , বলা হয়েই উঠল না।

একবার নববর্ষের আগে , বাবা কি কারণে হাতে কিছু টাকা পেয়েছেন । আমাকে নিয়ে গেছেন নিউ মার্কেটে , ইচ্ছে আমার মনোমতো শালোয়ার কামিজের পিস কিনে তৈরী করতে দেবেন । আমাকে পছন্দ করতে বলাতে , আমি দুখানা পছন্দ করলাম, এর মধ্যে যেকোনো একখানা নেবো কিন্তু বাবার শুকনো মুখ দেখে বুঝলাম, একটু বেশী দামীই পছন্দ করে ফেলেছি , বাবার বাজেটে হয়তো কুলোবে না । তৎক্ষণাৎ আমি অন্য একটা পিস বেছে নিয়েছি যার দাম অনেকটাই কম । বাবা হাসিমুখে দাম দিয়ে আমায় সেদিন আইসক্রিম খাওয়ালেন , মাদ্রাজি ক্যান্টিনে দোসা খাওয়ালেন। বাসে আসতে আসতে বার বার জিজ্ঞেস করলেন, আমার পিস টা পছন্দ হয়েছেতো, আমি জোর করে অন্যটা নিলাম না তো। আমার খুব রাগ হচ্ছিল, মনে হচ্ছিল, "বুঝতেই তো পারছো , কেন এটা নিয়েছি তাও খোঁচাচ্ছ কেন বাপু "। আমার অন্ধকার মুখ দেখে বাবার মুখ টাও সেদিন ক্রমশ ম্লান হয়ে যাচ্ছিল কেন সেটা সেই বারো বছরের মেয়ে বুঝতে পারেনি। অনেক পরে দুই সন্তানের জননী বারংবার বুঝেছে, সন্তানকে তার মনোমতো জিনিষটি খরিদ করে দিতে না পারলে বাপ মায়ের প্রাণে কতখানি ব্যথা বাজে। কিন্তু সেকথা তো কোনোদিন তোমায় বলা হল না বাবা, বলা হল না, তোমাকে সেদিন আমি বড্ড কষ্ট দিয়েছিলাম।

তোমাকে শেষবার নার্সিংহোম থেকে আনার পর , তুমি যখন খুব অস্থির হয়ে পড়েছিলে, তোমায় সিডেটিভ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেবার সময় বলেছিলাম, এখন ঘুমোও, পরে আবার কথা হবে। সেদিন বিশেষ কারনে আমায় চলে আসতে হয়েছিল। আসার সময় তোমায় বলে আসি নি । কিন্তু একদিন পর ফিরে গিয়ে আর তো তোমার সাথে কথা হল না। কত কথা যে এমন ই বাকি রয়ে গেল ।

"বসে বসে দিবা রাতি বিজনে সে কথা গাঁথি।
সে কথা ফুটিয়া উঠে কুসুমবনে,
সে কথা ব্যাপিয়া যায় নীল গগনে।
সে কথা লইয়া খেলি হৃদয়ে বাহিরে মেলি,
কত কথা তারে ছিল বলিতে ।। "

মন্তব্যসমূহ